বিজ্ঞান আশির্বাদ না অভিশাপঃ মাধ্যমিক বাংলা পরীক্ষায় প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান বিষয়ে একটি রচনাশৈলী লিখতে বলা হয়ে থাকে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসে থাকে 'বিজ্ঞান আশির্বাদ না অভিশাপ' , 'দৈনন্দীন জীবনে বিজ্ঞান', 'প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান'।
ভূমিকাঃ- ‘বিজ্ঞানমুচ্ছিষ্টম ইদম জগৎ' অর্থাৎ বিজ্ঞানের দ্বারা এ জগৎ উচ্ছিষ্ট। সভ্যতা যদি হয় যন্ত্র, তবে বিজ্ঞান সেখানে যন্ত্রী। কিন্তু, বিজ্ঞানের এত উন্নতি সত্ত্বেও সভ্যতার কপালে দুশ্চিন্তার কলঙ্করেখা। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার মাঝে একদিকে সৃজন, অন্যদিকে ধ্বংস। বিজ্ঞানের মারণ যজ্ঞে ত্রস্ত মানুষ তাই প্রশ্ন তুলেছে—বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ
একদিন মানুষে ছিল অরণ্যচারী। সেদিন পর্বতগুহায়, বৃক্ষশাখায় সে পশার মতই জীবন যাপন করত। তারপর দিনে দিনে সে শক্তি সংগ্রহ করেছে। আপন বুদ্ধিবলে সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে আজিকার সংসভ্য নাগরিক মানষে উন্নীত হয়েছে। বলা বাহল্য, এই উত্তরণ সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানেরই শক্তিতে।
বিজ্ঞানের জয়যাত্রাঃ- বিজ্ঞান শব্দের অর্থ বিশেষ জ্ঞান। মানুষের অদম্য কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসা মানষকে এই জ্ঞানার্জনে সহায়তা করেছে। একে একে মানুষ প্রকৃতির অনেক রহস্যেরই মর্মোদ্ধার করেছে। রাষ্ট্র-নগরের পত্তন করেছে। ক্রমে বিজ্ঞানের সাহায্যে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে বিজয়কেতন উড়িয়েছে ।
প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞানের দানঃ বিজ্ঞান আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে । প্রভাতে নিদ্রাভঙ্গ হওয়া মাত্রই মুখ ধৌত করার জন্য চাই দাঁতন ও মাজন । তারপর চা ও সংবাদপত্র। প্রাতরাশের পর পড়াশনার জন্য চাই বই, খাতাপত্র ও পেনসিল। আমরা একবারও ভাবিয়া দেখি না, এ সবই বিজ্ঞানের দান। বেলা বাড়িলে ছেলেমেয়েরা যায় স্কুলে-কলেজে, বড়রা যায় কর্মস্থলে। এই যাতায়াতের প্রধান বাহন বাস-ট্রাম-রিকশ-সাইকেল——সবই বিজ্ঞানের দান।
গরম বোধ হলে বিজলী পাখা চালাই। দিনের শেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসা মাত্রই বিজলী আলোর সাইচ টিপে দিই। চিত্তবিনোদনের জন্য আর সিনেমা-থিয়েটারে যাওয়া লাগে না, ঘরে বসে বা কোনো বসার জায়গাতেই মোবাইলেই দেখে নেওয়া যায়। আর এই সবই সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব কল্যানের ফলে। তাহা ছাড়া, শীত ও গ্রীষ্মে, সকাল-সন্ধ্যায় পোশাক-পরিচ্ছদের বিপলে আয়োজন, টুকিটাকি প্রসাধন—সবই বিজ্ঞানের আনুকূল্যে পাওয়া। বস্তুতঃ, শয্যাত্যাগ হইতে শয্যাগ্রহণ পর্যন্ত বিজ্ঞান আমাদের নিত্য সহচর।
বৃহত্তর ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদানঃ শুধু প্রাত্যহিক জীবনে কেন?, জলে-স্থলে-অস্বরীক্ষে সর্বত্রই বিজ্ঞানের বিজয় কেতন উড়েছে। জলে জাহাজ ইত্যাদি জলযান,স্থলে ট্রাম-বাস-ট্রেন, শূন্যে উড়োজাহাজ, মহাশূন্যে রকেট, কৃত্রিম উপগ্রহ – সবই বিজ্ঞানের সৃষ্টি। পাতালপুরীর ঐশ্বর্য, সাগরতলের মণিমত্তা বিজ্ঞানের সাহায্যে মানুষ তুলে এনেছে। বিজ্ঞানের বলেই আজ মানুষে গ্রহান্তরেও গাড়ি জমাচ্ছে। চন্দ্রলোকে পদার্পণ বিজ্ঞানের বলেই সম্ভব হয়েছে।
বিজ্ঞানের সাহায্যে মানুষ দুর্জয় প্রকৃতিকেও অনেকটা বশে এনেছে। বন্যার বিপুল জলরাশিকে সুদৃঢ় বাঁধে আবদ্ধ করে মানুষের কল্যাণকর কার্যে নিযুক্ত করেছে ৷
চিকিৎসাশাস্ত্রে বিজ্ঞানের দান অসীম। এমন কোন দুরারোগ্য ব্যাধি নাই, যাহার ঔষধ আবিষ্কৃত হয়নি। পেনিসিলিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, ক্লোরোমাইসেটিন, রেডিয়াম, এক্স-রে – সবই বিজ্ঞানের গবেষণার ফল শল্যচিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে সাফল্য লাভ করেছে দারুণভাবে। বর্তমানে কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন থেকে শুরু করে বিভিন্ন রোগ নির্ণয় ইত্যাদির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান অনোস্বিকার্য ।
বিজ্ঞানের কল্যাণে সমস্ত পৃথিবী আজ আমাদের ঘরের দুয়ারে এসে পৌঁচেছে। অর্থ থাকিলে শব্দের চেয়েও দ্রুতগামী বিমানে যে কোন স্থানে যাইতে ঘরের দুয়ারে আসতে পারা যায়। দ্রুতগতিসম্পন্ন ট্রেন আবিষ্কার করে মানুষ হাজার কিলােমিটারের পথকে করেছে অতিসন্নিকটে।
আধুনিক টেলিযােগাযােগ তাে বিজ্ঞানের বিরাট সাফল্য। মিনিটের মধ্যে গােটা বিশ্বের যেকোনাে প্রান্তের সংবাদ নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। সংবাদপত্রের মাধ্যমে আজ চিলির খবর চীনে পৌঁছাইতে কয়েক ঘণ্টার বেশী সময় লাগে না। টেলিভিশন ও মোবাইলের মাধ্যমে আমরা ঘরে বসেই পৃথিবীর যে কোন স্থানের খবর নিতে ও দেখিতে পাই ।
বিজ্ঞানের অভিশাপঃ কিন্তু বিজ্ঞান আশীবাদের সহিত কিঞ্চিৎ অভিশাপও বহন করে এনেছে। মারাত্মক সব মারণাস্ত্র বিজ্ঞানেরই আবিষ্কার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আণবিক বোমার একটিমাত্র আঘাতে হিরোসিমার মত সমৃদ্ধ নগরী ধ্বংস হয়েগিয়াছিল। স্বার্থান্ধ শক্তিবর্গ দিন দিন মারণাস্ত্রের ভাণ্ডার পূর্ণ করে চলেছে। আরব-ইস্রায়েল, ভিয়েতনামের রণাঙ্গণ আপাতত শান্ত হয়েছে, কিন্তু ইরাক-ইরাণে আবার যুদ্ধের আগুন জ্বলিতেছে।
উপসংহারঃ কিন্তু বিজ্ঞানের এই বিধ্বংসী শক্তির জন্য মানুষের অশুভ বাম্বিই দায়ী। বিজ্ঞানের লক্ষ্য একান্তভাবেই গঠনমমূলক। অতএব মানষের শুভ বুদ্ধি জাগ্রত হউক, মাননুষের শুভ প্রচেষ্টায় যুক্ত হয়ে বিজ্ঞান বিশ্ববাসীর জীবনযাত্রাকে উন্নত থেকে উন্নততর করে তুলুক। নরকের অভিশাপ নয়, অমরলোকের আশীবর্দিই বিজ্ঞান বহন করে আনিবে।
No comments:
Post a Comment